অধ্যায় - ৩
একটা একটা করে দিন পেরিয়ে ডিসেম্বরের শেস সপ্তাহের শেস দিন ।
ফেসবুকের দৌলতে সামনা-সামনি দেখা অথবা কথা না হলেও অংশু তিয়াসের কথোপকথোনের পরিমান
বেশ অনেকটাই পরিণত হয়ে উঠছিল খুব দ্রুত ।
রাত বারোটার ঘন্টা যখন পড়ল নতুন বছরের চিৎকারে মেতে উঠল গোটা
পার্কস্ট্রিট । চারিদিক থেকে বেলুন উড়ে নীল আকাশ টা ঢেকে দিল এক নতুন রঙ্গে , রঙ-বে-রঙ্গের
আলোয় অতিপরিচিত সাদাকালো শহরটাকে রঙ্গীন করে দেবার চেষ্টায় মেতে উঠল বিদেশীরা আর তাদের
সঙ্গ দিচ্ছিল বাঙালিরা । এই উৎসবে সামিল হতে অংশুও এসেছিল তার কিছু বন্ধুদের সাথে ।
নতুন বছরের এই রোমাঞ্চকর উৎসবে সে আগে যোগদান করেনি । চারিদিকে এত রঙ দেখে রঙ্গীন হতে
ইচ্ছে কার করেনা । বন্ধুদের পাশাপাশি সেও এক আশ্চর্য আনন্দে নিজেকে সঁপে দিল । কিন্তু
একটা ছোট্টো পার্থক্য সে আর পাঁচ জনের সাথে তৈরি করে নিচ্ছিল নিজের অজান্তেই ।
সবকিছুর মধ্যে অংশুর মন পড়েছিল সেই সময়ের দিকে , মোবাইলের সেই
ছোট্ট কম্পনের দিকে যেটা তিয়াসের মেসেজ এলে সৃষ্টি হবে আর অংশুর নতুন বছরের কুড়িয়ে
পাওয়া আনন্দটা সম্পুর্ণ হবে তিয়াসের সাথে নিজের সময়টা ভাগ করে নিয়ে ।
নাচ , গান আর বন্ধুদের সাথে সেলফি তোলা থেকে নিজেকে বের করে
আনল সে । দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার ওপারে ফুটপাতের রেলিঙ এ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল
। মোবাইলটা আনলক করে তিয়াস কে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাল এবং জ্যাকেটের পকেটে ফোনটা
রেখে সিগারেটের তিক্ত ধোঁয়া অমৃতের মত পান করতে থাকল
অংশু।
সিগারেট
অংশুর ঠিক নেশা নয় , ভালো না লাগা সময় গুলো খুব তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য সিগারেট টা
শুধু ব্যবহার করে মাত্র । ঠিক সেইভাবেই কৃত্রিম ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে রাস্তার ওপারের
রঙ্গীন আলোগুলো দেখতে থাকল আর মনে মনে যেন তিয়াস কে ডাকছিল আর ভাবছিল সে যদি আজ
তার পাশে থাকত , মজাটা এক অন্য মাত্রা পেত ।
ফাঁকা
রাস্তা দিয়ে খুব জোড়ে ছুটে জাওয়া গাড়িগুলোর আচমকা হাওয়ায় সিগারেটের ধোঁয়াগুলো মাঝে
মাঝে লাইন ভেঙ্গে বেলাইন হয়ে যাচ্ছে , অংশুর দৃষ্টি স্থির হয়ে ধোঁয়াগুলোর সেই
অবাধ্যতা দেখছিল । হটাৎ করে একটা শব্দে অংশুর স্থিরতা ভেঙ্গে গেল । পকেট থেকে
ফোনটা বের করতেই কি যেন এক খুশি ঠোঁটের এক কোনে খুব শান্ত মৃদু হাসির একটা অস্পষ্ট
রেখা সৃষ্টি করল তার ।
তিয়াসের
মেসেজ । তিয়াস ঘুমায়নি এখনও । মায়ের পাশে শুয়ে মায়ের ঘুমিয়ে যাবার পরে আবার ফেসবুক
খুলেছে সে । সেও শুভেচ্ছা দিল অংশুকে । অংশু পার্কস্ট্রিটের নতুন বছরের উৎসবের
বর্ননায় তিয়াসের চোখের সামনে নতুন বছরের নতুন ধরনের উৎসব তুলে ধরল যা সেও আগে
কোনদিন উপভোগ করেনি । তিয়াসের মনে এক নতুন অনুভুতির সৃষ্টি করছিল অংশুর সেই বর্ননা
। অংশুর কথা বলা তিয়াসের মনে আর পাঁচজনের সাথে তাকে আলাদা করে রাখতে বাধ্য করল ।
বেশকিছুক্ষন
পর হটাৎ অংশু নিজের ফোন নাম্বার টা দিয়ে তিয়াস কে বলল সে যেন পরে তাকে মিসকল দেয়
তাহলে তার নাম্বারটা অংশু পাবে । তিয়াস অংশুকে তার নাম্বার ফেসবুকেই মেসেজ করে দিল
সঙ্গে সঙ্গে , যেন সে ঠিক এটাই চাইছিল ।
তিয়াসের
সাথে কথা বলতে বলতে অংশুর মনেই ছিলনা তার বাঁ হাতে সিগারেট টা জ্বালানো ছিল । সেটা
অংশুর খুশিতে নিজেকে পুড়িয়ে তার সমস্ত দেহই প্রায় নিঃস্বেস করে ফেলেছিল এবং শেষ
অংশটুকু যেটা অংশুর দুই আঙ্গুলে মধ্যে বন্দি ছিল সেই পুড়তে থাকা আগুন বন্দিদশা
থেকে মুক্তি পাবার আন্দলনে আঙ্গুলে সজোড়ে ছ্যাঁকা দিল । আচমকা এই আঘাতে বাঁ হাতটা
নিজেকে ঝাকিয়ে তুলল এবং ক্ষনিক অন্যমনষ্ক হতেই ডান হাতে আলত করে ধরে থাকা ফোন টা
মাটিতে পড়ে গিয়ে খুলে গেল । ব্যাটারিটা লাগিয়ে সুইচ টা টিপতে ফোনটা
অন হল বটে কিন্তু আবার অফ হয়ে গেল । এই সময়ে সাধারন মানুষের খুব রাগ হওয়ার কথা , অংশুরও রাগ হল
ঠিকই কিন্তু সে এতটাই খুশি ছিল যে ফোনটা কেন অন হচ্ছেনা তার দিকে কোন দৃকপাতই করলনা
। তার মনে হচ্ছিল এই ভালোলাগাটাই সে যেন খুজচ্ছিল অনেকদিন ধরে , এক খুব অচেনা সুখে
নিজেকে সবথেকে সুখি মনে করছিল সে । রাস্তার ওইপার থেকে অংশু বলে কেউ একজন ডাকতে যাই
বলে সাড়া দিয়ে হাসতে হাসতে রাস্তা পার হল । পার্ক্সট্রিট থেকে বেরিয়ে সব বন্ধুরা একে
অপরের ঘাড়ে হাত রেখে এগোতে শুরু করল বাসার দিকে ।
পরের দিন সকালবেলা খুব তারাতারি ঘুম ভেঙ্গে গেল অংশুর । ফোনের
চার্জ কমপ্লিট হয়ে গেছে দেখে তারটা খুলে ফেসবুক খুলল । তিয়াসের ইনবক্স টা দেখতে দেখতে
গতকালের কথাগুলো মনে করছিল আর হাসছিল মনে মনে । তিয়াসের দেওয়া নাম্বারে সুপ্রভাত লিখে
এস এম এস করে আবার লেপের তলায় মাথাটা ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে শুধু ভাবতে থাকল সেই পুরনো
মুখ যেটা এখন হয়ত অনেকটাই পালটে গেছে আর ফেসবুকে হওয়া কথাগুলো ।
বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সবে একটা চুমুক
দিয়েছে , ফোন টা বেজে উঠল সুন্দর একটা জ্যাস মিউসিকের রিংটোনে ।
অচেনা নাম্বার দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে “হ্যালো !”
ফোনের ওপার থেকে একটি মেয়ের গলা শুনতে পেল অংশু । গলাটা শুনে
বেশ অবাক হয়ে গেল । একদম অচেনা একটি গলা । গলার মধ্যে এক শান্তি অনুভব করে প্রথমে কিছুক্ষন
কথাই বলতে পারলনা অংশু ।
কিছুক্ষন থেমে “ হুম অংশু বলছি । আপনি ? ”
“ আরে আমি তিয়াস , যা- আমাকে চিন্তেই পারলিনা !! ”
অংশুর কথা আটকে যেতে থাকল । কি বলবে ও যেন খুজেই পাচ্ছিলনা এবং
যদিও বা অনেক অনেষ্বনের পর খুজে পাচ্ছিল সেটা ওর মুখে আসতে আসতেই হারিয়ে যাচ্ছিল ।
অংশুকে চুপ দেখে তিয়াস নিজেই আবার বলল “আরে তুই আমায় মেসেজ করলি
, আমি তার উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম ফোনে মেসেজ করার মত টাকা নেই , তাই বাবার ফোন থেকে
তোকে ফোন করছি । “
অংশু নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল এবং বেশ অনেক্ষন
ধরেই পরস্পরের আওয়াজ ফোনের এপার থেকে ওপার আর ওপার থেকে এপারে পাঠাতে থাকল ।
সময়ের সাথে সাথে তাদের কথোপকথন বারতে থাকল । তারা নিজেদের জন্য
নতুন নামকরন করেছিল । সাধারণ মানুষের কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও এই নামকরন তাদের আরও কাছে
আনছিল পরস্পরকে এবং তারা ওইনামেই তাদের ডাকত । তিয়াস অংশুকে নিজের নামে ডাকত আর অংশু
তাকে ডাকত অংশু নামে । মেসেজ তো আছেই তার সাথে মাঝে মাঝে গলার আওয়াজ মিশে তাতে এক অন্য
রুপ আনছিল যেন । একের পর এক কবিতায় ভরে উঠছিল খাতার পাতা গুলো , ফোনের পাসওয়ার্ড এ
কিছু সংখ্যা তিয়াসের নামের বানানে পরিবর্তিত এখন , খাতা বইএর আনাচ কানাচ শুধু তিয়াস
বানানের নকশায় ভরে উঠেছিল ।
দিনের পর দিন , সপ্তাহের পর
সপ্তাহ , মাসের পর বেশ অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেল । তিয়াসের কথা , অংশুর প্রতি বার
বার এক অপরুপ যত্ন অংশুর জীবনে এক নতুন জীবনের জন্ম দিয়েছিল যেখানে অংশু তিয়াস
ছাড়া আর কারোর অস্তিত্বই খুজে পেতনা । কিন্তু তার এই অচেনা অনুভবের কথা সে তিয়াস
কে কিছুতেই বলতে পারতনা ।
তিয়াস পশ্চিম বঙ্গের বাইরে অন্য
রাজ্যে নামকরা প্রথম সারির এক বিশ্ববিদ্যালএ মাস্টার ডিগ্রির পরাশোনা করত । পরীক্ষার
পর ছুটিতে অনেকদিন বারিতে থাকার পর ফিরে যাবার সময় এলো একদিন । ট্রেন ছিল বিকেল
বেলা । তিয়াসের সাথে দেখা করার জন্য অংশু এই সুজোগ কিছুতেই ছাড়তে পারলনা । সে ঠিক
করল বিকেলে সে তার সাথে দেখা করবেই । সাড়ে পাঁচটার ট্রেন । ল্যাপটপের ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখল পাঁচটা বেজে গেছে । তাড়াতাড়ি তিয়াস নামের যে কবিতাটা সে লিখেছিল সেটা
ফেসবুকে তাকে মেসেজ করল । এই কবিতা ছিল একেবারে অন্যরকম , যেখানে তার মনের সমস্ত
অনুভব , ভাবনা কবিতার আকারে লিখেছিল মুখে বলতে পারছিলনা বলে । এক কথায় বললে ওই
কবিতায় একটাই কথা ছিল , অংশু তিয়াস কে ভালবেসে ফেলেছে ।
ঘড়িতে পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট ,
উর্ধ্ব শ্বাসে সাইকেল নিয়ে ছুট দিল স্টেশনের পথে । ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল এক নম্বর
প্ল্যাটফর্মে , তিয়াসের সাথে তার বাবা থাকায় অংশু এক নম্বর দিয়ে না গিয়ে গেল তিন
নম্বর এ , জানলা দিয়ে তিয়াস কে দেখবে বলে । কিন্তু ভগবান বোধহয় এখনি তাদের দেখা
হোক তা চাইছিলেন না । তিন নম্বরে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল । ট্রেন ছাড়ার সময় চলে
এলেও মালগাড়ি তার জায়গা থেকে এক চুল সড়বেনা এই ভাবনায় দৃঢ় ছিল । ঠিক কোন বগিতে
তিয়াস আছে তা জানার জন্য অংশু তাকে ফোন করল । অংশু স্টেশনে এসেছে শুনে তিয়াস ভীষন
অবাক হয়ে বার বার একটাই প্রশ্ন করছিল “ তিয়াস তুই আমায় আগে কেন বললিনা যে এখানে
আসবি ! কোথায় তুই আমি তো দেখতে পাচ্ছিনা । ”
“ আরে আমি তিন নম্বরে আছি ভাবলাম
এদিক থেকে দেখা করব , কিন্তু এই মালগাড়িটা তো যাচ্ছেইনা । ”
তিয়াসের বাবা প্ল্যাটফর্মে
দাঁড়িয়ে ছিল , হটাৎ সিটে এসে বসে তিয়াস কে খবর দিল ট্রেন এবার ছাড়বে । তিয়াস
কিছুটা থতমত খেয়ে রাখছি বলে ফোন টা রেখে দিল ।
মাল গাড়িটার দুটো বগির মাঝখানে
যে ছোট্টো ফাঁক থাকে প্রথম থেকে শেষ অব্দি সেই ফাঁক দিয়ে তিয়াস কে দেখার আপ্রাণ
চেষ্টা করল কিন্তু তাকে দেখতে পেলনা সে । পাঁচটা ত্রিশ পেরিয়ে গেছে , খুব জোড়ে
হর্ন বাজিয়ে ট্রেন টা চলতে শুরু করল আর
অংশুর এই ব্যর্থতা দেখে যেন বারে বারে উপহাস করছিল তাকে ।
অংশুর সাথে তিয়াসের দেখা হয়নি
ঠিকই কিন্তু তিয়াসের শহর ছেড়ে চলে যাওয়াটা অংশু কিছুতেই মানতে পারছিলনা । নিজেকে খুব
একা মনে হচ্ছিল তার । যেন সব খুশি , সব আনন্দ তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে , এই মনে
হচ্ছিল বারে বারে । রেল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ট্রেন এর দিকেই তাকিয়ে থাকল একভাবে ।
ট্রেনটা আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকল । দূর থেকে দূরে যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে গেলো । চোখের জল টা গাল বেয়ে গড়িয়ে হাতের ওপর পড়তে
তার খেয়াল হল যে সে স্থির থাকলেও তার চোখ স্থির থাকতে পারেনি । তাড়াতাড়ি চোখটা
মুছে রেল গেট টা পেরিয়ে এক বন্য উদাসিনতায় মনটাকে ঢেকে চুরান্ত নিথর গতিতে এগোল
বাড়ির পথে ।
PREVIOUS CHAPTER NEXT CHAPTER
COPYRIGHT© : This story is written by Nilangshu Chatterjee and it’s his property . Copying this or doing anything without permission of Nilangshu Chatterjee will be treated as violation and Nilangshu Chatterjee has all rights to take legal step . ** All the characters , names , places , dates , situations , incidents etc are imaginary .
PREVIOUS CHAPTER NEXT CHAPTER
COPYRIGHT© : This story is written by Nilangshu Chatterjee and it’s his property . Copying this or doing anything without permission of Nilangshu Chatterjee will be treated as violation and Nilangshu Chatterjee has all rights to take legal step . ** All the characters , names , places , dates , situations , incidents etc are imaginary .
0 comments:
Post a Comment